বিশেষ প্রতিবেদনঃ২৭জুলাই
১৯৯৪ সালের ২৬ জুলাই যুদ্ধাপরাধী জামায়াতপ্রধান গোলাম আযমের চট্টগ্রাম আগমন ও ঘোষিত জনসভার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে জামায়াত–শিবিরের ঘাতকদের গুলিতে ছাত্র লীগ ও নির্মূল কমিটির পাঁচজন তরুণ কর্মী শহীদ ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন। নিরস্ত্র মিছিলকারীদের উপর জামায়াত–শিবিরের সন্ত্রাসীদের এই নৃশংস হামলায় সর্বস্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ঘাতক চক্রের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রবলতর হয়েছে। চট্টগ্রামের বীর শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর নির্মূল কমিটি ২৬ জুলাই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
গতকাল ২৬ জুলাই বিকেল ৩টায় চট্টগ্রামের শহীদদের স্মরণে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি চট্টগ্রাম শাখার উদ্যোগে ‘জঙ্গী মৌলবাদী প্রতিরোধে সরকার ও নাগরিক সমাজের দায়িত্ব’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।
নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়কারী ও কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক শওকত বাঙালীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অনলাইন আলোচনা সভার প্রধান বক্তা সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির তার ভাষণে চট্টগ্রামের তরুণ শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামের দোহাই দিয়ে যাদের হত্যা করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল তরুণ মুক্তিকামী বাঙালি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানে জামায়াতে ইসলামী সহ ধর্মের নামে সকল সংগঠন নিষিদ্ধ করেছিলেন।
যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বঙ্গবন্ধু বাতিল করেছিলেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের নীলনকশা অনুযায়ী সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে ধর্মের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি চালু করেছেন। গত তিরিশ বছর ধরে নির্মূল কমিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির চক্রের ধর্মের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একটানা বার বছর ক্ষমতায় থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করলেও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের কোনও উদ্যোগ নেয় নি। এর ফলে রাজনীতি ও সমাজে জঙ্গী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জমি উর্বর হচ্ছে। হেফাজতে ইসলামও হরকতুল জেহাদ থেকে আরম্ভ করে সব জঙ্গী সন্ত্রাসীদের গডফাদার হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। মাঠ পর্যায়ের কিছু জঙ্গী নেতাকর্মী গ্রেফতার করলেই বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ মুক্ত হবে না। জঙ্গীবাদকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
জামায়াত-হেফাজতের প্রতি যে কোনও ধরনের নমনীয়তা সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের দর্পণ ’৭২-এর সংবিধান পুনপ্রবর্তন করেই বাংলাদেশ থেকে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে। জামায়াত-হেফাজতের ধর্মের নামে সন্ত্রাসের রাজনীতি অব্যাহত থাকলে অন্তিমে বাংলাদেশ মৌলবাদী জঙ্গীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।’
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সাঃ সম্পাদক কাজী মুকুল, চ.সি.ক সাবেক প্রশাসক আলহাজ্ব খোরশেদ আলম সুজন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর হান্নানা বেগম, গোলম আজম প্রতিরোধ আন্দোলনকালীন ছাত্রলীগের মহানগর সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাঃসম্পাদক মফিজুর রহমান, নির্মূল কমিটি জেলা সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, মানবাধিকার নেত্রী ব্যারিস্টার তানিয়া আমির, অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, সাঃ সম্পাদক ডা. মামুন আল মাহতাব, কার্যকরী সাঃসম্পাদক অলিদ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম জেলার মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা রুবা আহসান সহ কেন্দ্রীয়, বিভাগীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দ।
কেন্দ্রীয় সাঃসম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, ‘বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে তালেবানি শক্তির উদ্ভব হয় কিনা তা চিন্তার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই। আমাদের রাজনীতি, জঙ্গীবাদÑমৌলবাদ বোঝার চেষ্টা করে না। ফলে সমাজে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে আমাদেরকে হেফাজতের তাণ্ডব দেখতে হচ্ছে।
এর প্রতিরোধে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ত্যাগ এবং বীরত্বের জায়গাগুলো তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই না করতে পারলেও এ সম্বন্ধে তথ্য উপাত্ত বিভিন্ন মাধ্যমে সরবরাহ ও প্রচার করতে পারি। জঙ্গীবাদ সীমা অতিক্রম করলে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা ছাড়া উপায় থাকে না।’
মানবাধিকার নেত্রী ব্যারিস্টার তানিয়া আমির বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কথা বললেও আমাদের নীতি নির্ধারণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভোটের রাজনীতি করার ফলে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে লালন পালন করছি ও আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছি। সেরকম মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকেও আমরা এমন স্থানে নিয়ে গিয়েছি যে ভবিষ্যতে সব স্তরে এরাই প্রতিষ্ঠিত হবে। নীতি-নির্ধারণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা অবিরাম ভুল করে যাচ্ছি।’
চিকিৎসা সহায়ক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘বিশ্বে এখন যেমন কোভিড-১৯ কে মোকাবিলা করার জন্য প্রতিষেধক হিসাবে ভ্যাকসিন ব্যবহার করছি। তেমন এখন জঙ্গী মৌলবাদকে যদি ভয়ঙ্কর ভাইরাস মনে করি এর প্রতিষেধক হিসাবে সাংস্কৃতিক বিকাশ একান্তভাবে প্রয়োজন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও সামরিক সরকারের আমলে জঙ্গী মৌলবাদের প্রচার প্রসার ঘটেছিল এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে কিনা প্রশ্ন থেকেই যায়। আপাতদৃষ্টিতে তাদের প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও তাদের মানসিক বিকাশ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ঠিক আগের মতই এখনও বিদ্যমান। এই দিক থেকে আমাদের তরুণ সমাজ, ছাত্র সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রোডাকশান হাউজগুলো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিরব ভূমিকা পালন করছে বিধায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ভিপি একজন বিএনপি-জামায়াতের নীলনকশার ফলাফল প্রমাণ করে।
পক্ষান্তরে তাদের প্রোডাকশান হাউসগুলো আমাদের পরোক্ষ নিরবতায় তারা সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বার বৎসরেও সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই দায় সরকার যেমন, তেমন আমরাও সেই দায় এড়াতে পারি না।’
নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়ক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং তারপর তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানের বিপুল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে আসাটা এই অঞ্চল বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। শোনা যাচ্ছে এরই মধ্যে ৭০০০ এরও বেশি বাংলাদেশি মুজাহিদ তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানে পাড়ি জমিয়েছেন। পাশাপাশি ভারত ও বাংলাদেশের জঙ্গীদের মধ্যে সহযোগীতার বিষয়টিও এই দুই দেশে বেশ কিছু জঙ্গীর সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের পর সামনে চলে এসছে।
তার উপর বাংলাদেশে এসে জেকে বসেছে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা যাদের মধ্যে আরছা নামধারী জঙ্গীদের উপস্থিতিও সর্বজনবিদিত। এরই মধ্যে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর রোহিঙ্গা জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের একাধিক হামলার খবর জানা যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নতুন ভূ-রাজনৈতিক সক্ষমতা বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। সব মিলিয়ে সামনের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে, যা সরকারের একার পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন। এই পরিস্থিতিতে নির্মূল কমিটির মতো সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণরাই একদিন জঙ্গী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়বে।
২৬ জুলাই সকাল ৯টায় চট্টগ্রামে নির্মূল কমিটির বিভাগীয় সমন্বয়কারী সাংবাদিক শওকত বাঙালীর নেতৃত্বে জেলার নেতৃবৃন্দ শহীদদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক প্রদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
Discussion about this post