করোনাভাইরাসের এই মহামারীর সময় সীমিত পরিসরেও আদালতের কার্যক্রম চালু না করার অনুরোধ করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সমাজসেবক ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পুর্বে ফেসবুক লাইভে প্রধান বিচারপতির কাছে এই অনুরোধ করেন তিনি।
ভিডিওতে তিনি বলেন- এই মুহুর্তে ভালো নেই সারা বাংলাদেশ। প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগী। এই মুহুর্তে জুমার নামাজের পূর্বে আমি আমার এই ভিডিওটিতে প্রধান বিচারপতি মহোদয় ও সুপ্রিম কোর্টের নীতি নির্ধারণী যারা আছেন তাদেরকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
তিনি বলেন – আমি প্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে। আমি নিজে একজন আইসজীবী হিসেবে গতকাল চিঠি পেয়েছি যে স্বল্প পরিসরে আগামী মাসের ৫ তারিখ থেকে আদালতের কার্যক্রম চালু করতে চান। আমি একজন আইনজীবী হিসেবে অনুরোধ করে বলি- যারা প্রধান বিচারপতিকে এই বিষয়গুলো বুঝিয়েছে তারা অবশ্যই ভালো লোকজন নয়। আমরা আদালত কেন নিজেদেরকে দোষী বানাতে চাই গার্মেন্টস মালিকদের মত।
তিনি বলেন – যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আদালত যারা খুলতে চায় তারা অবশ্যই বিচার বিভাগের ভালো চায় না। তিনি মাননীয় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সারা দেশকে যেখানে লকডাউন ঘোষণা করেছে সেখানে আদালতের কার্যক্রম চালু করে ভাইরাসের বিস্তার ঘটানো কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন যে, মাননীয় বিচারপতি- আপনি খেয়াল করলে দেখবেন বিজিএমইএসহ পোশাক খাতের যারা মালিক আছে তারা গার্মেন্ট শ্রমিকদের দিয়ে সিদ্ধান্তহীন কার্যক্রম চালিয়ে অনেকটাই বিতর্কিত হয়েছে। আদালত তেমন বিতর্কিত হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন আমরা যদি আর ৮/১০ দিন অপেক্ষা করি এবং পরিস্থিতি আরও ভাল করে বুঝি এবং সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে একমত থাকি সেটা অবশ্যই আমাদের জন্য ভাল হবে।
তিনি বলেন – আমরা আইনজীবীরা অবশ্যই যার যার বাড়ি থেকে মানুষের সহযোগিতা করতে পারি। আইনজীবীদের ভূমিকার সারা পৃথিবীতে সব কিছুতেই থাকা উচিত। এই মুহূর্তে আইনজীবিদের উচিত যার যার অবস্থান অনুযায়ী মানুষের সাহায্য সহযোগিতা করা। একই সাথে তিনি বলেন আইনজীবীদের মধ্যে যদি কেউ গরিব অসহায় থাকে আমরা আদালতে আইনজীবীর আমরা অবশ্যই তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবো। তিনি বলেন- আইনজীবীদের সহযোগিতার জন্য সরকারের কাছে ৬০ কোটি টাকার সাহায্য চাওয়া এটা অবশ্যই আমাকে লজ্জিত করেছে।
নিজেকে তখন ফকিরের মত মনে হয়েছে। আমরা কেন সরকারের কাছে সাহায্য চাইবো। আমরা আমাদের বার কাউন্সিলে প্রতি মাসে মাসে যে টাকা দেই সেখান থেকেই তো আইনজীবীদের সহযোগিতা করা যায়। আইনজীবিরা গরীব হতে পারে কিন্তু কোন ফকিরের মানসিকতা রাখে না। যারা সংবিধানের সুরক্ষায় কাজ করে তারা এমন মানসিক দৈনদশায় ভুগতে পারে না। এ ধরণের সাহায্য চাওয়ার ভূমিকায় আমাদের মধ্যে আর দুর্নীতিবাজ গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না।
তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ রেখে বলেন – এমন একটা পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদেরকে অবশ্যই কলঙ্কিত করবেন না। তিনি বলেন যারা এমন এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে এই বিষয়টা বুঝিয়েছে তারা অবশ্যই বিচার বিভাগের ভালো চায়না। গুটিকয়েক মানুষ তাদের কিছু স্বার্থের জন্য এমন সিদ্ধান্ত করেছে তারা ভালো কিছু চায় না। এবং তারা আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করে না।
তিনি বলেন- স্বল্প পরিসরে হোক আর বৃহৎ পরিসরে হোক আদালত খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আইনজীবীরা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়বে কেনননা অনেকেই চাচ্ছে এখন আদালত খুলে দেয়া হোক তাই আমি অনুরোধ করব এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করুন এবং আদালত খোলারে সিদ্ধান্তটি বৃহৎ স্বার্থে বাতিল করুন।
একই সাথে তিনি রুপরেখা রেখে বলেন যদি একান্ত জরুরী বিষয় হয় তাহলে তো এজলাসে না বসেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিচারপতিরা রুমে বসেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেই সাথে তিনি অনুরোধ রেখে বলেন আমার এই লাইভ ভিডিওকে ভিন্ন কোন বিষয়ে চিন্তা না করে বরং আমি বিচার বিভাগের ভালো চাই বলেই এমন অনুরোধ করছি এমনটা বিবেচনা করার অনুরোধ থাকবে মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে।
প্রসঙ্গত : সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা কঠোরভাবে প্রতিপালনের শর্তে সীমিত পরিসরে সুপ্রিম কোর্ট চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। সেই সঙ্গে আগামী ৫ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে আদালতের সাধারণ ছুটি। তবে এ ছুটির মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিচারকের সুবিধামতো সপ্তাহে যেকোনো ২ দিন জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতের কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতর। রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবরের স্বাক্ষরে এ সার্কুলার জারি করা হয়। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট বারসহ বিভিন্ন আইনজীবী সমিতি এবং আইনজীবীদের সংস্থা যে কোনো আদলে সীমিত পরিসরে আদালতের কার্যক্রম শুরুর অনুরোধ জানায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আপিল বিভাগের বিচারপতিগণের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার শর্তে সীমিত পরিসরে আদালতের কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানান, সীমিত পরিসরে শর্ত সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট এবং সপ্তাহে দুই দিন দেশের জেলা দায়রা জজ আদালত চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সঙ্গে আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিগণের বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আদালত চালুর সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আগামী ৫ মে পর্যন্ত ছুটিও বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর।
এদিকে রেজিস্ট্রার জেনারেল দফতর থেকে জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়, দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস রোগ (কোভিড-১৯) সংক্রমণ মোকাবেলা এবং এর ব্যাপক বিস্তার রোধকল্পে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগামী ৫ মে ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সকল আদালত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দেশের প্রত্যেক জেলার জেলা ও দায়রা জজকে এবং মহানগর এলাকার মহানগর দায়রা জজকে ছুটিকালীন সময়ে তার সুবিধামতো প্রতি সপ্তাহে যেকোনো দুই দিন কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জরুরি জামিন (কারাগারে থাকা আসামির আবেদনসহ) শুনানির নিমিত্তে সীমিত আকারে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হলো।
চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্র্রেট নিজে অথবা তার নিয়ন্ত্রণাধীন এক বা একাধিক ম্যাজিস্ট্র্রেট দ্বারা ছুটিকালিন সময়ে তার/তাদের সুবিধামতো প্রতি সপ্তাহে যেকোনো দুই দিন কঠোর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জরুরি জামিন শুনানির জন্য সীমিত আকারে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো।
গত ১১ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের জারিকৃত সার্কুলারের ধারাবাহিকতায় বলা হয়, যে সকল ফৌজদারি মামলায় আসামিকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জামিন দেয়া হয়েছে কিংবা যেসব মামলায় উচ্চ আদালত থেকে অধস্তন আদালতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের শর্তে জামিন দেয়া হয়েছে কিংবা যেসব মামলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, স্থিতাবস্থা, স্থগিতাদেশের আদেশ দেয়া হয়েছে সেসব মামলার আদেশের কার্যকরিতা আদালত নিয়মিতভাবে খোলার তারিখ থেকে পরবর্তী ২ সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে-মর্মে গণ্য হবে। সাধারণ ছুটিকালিন সময়ে উক্ত মামলা সমুহের বিষয়ে কোনো আবেদন শুনানি গ্রহণ করা হবে না।
একটি মামলার জামিন শুনানিতে কেবলমাত্র একজন আইনজীবী অংশ গ্রহণ করবেন। আদালত প্রাঙ্গণ এবং এজলাস কক্ষে সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন কঠোরভাবে অনুসরণ না হলে আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে। আদালত প্রাঙ্গন এবং এজলাস কক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে স্ব স্ব আইনজীবী সমিতির সভাপতি,সাধারণ সম্পাদক এবং কার্যকরি কমিটির সদস্যদের সাথে আলোচনাক্রমে জেলা ও দায়রা জজ মহানগর দায়রা জজ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। জামিন শুনানিকালে কারাগারে থাকা আসামিদের কারাগার থেকে প্রিজনভ্যান কিংবা অন্য কোনোভাবে আদালত প্রাঙ্গণ ও এজলাস কক্ষে হাজির না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ১১ এপ্রিল করোনা বিস্তার রোধকল্পে কোনো অবস্থাতেই সীমিত পরিসরেও আদালতের কার্যক্রম চালু না রাখার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
Discussion about this post