দেশ ত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ দাবিতে তারা জাতীয় শহীদ মিনারে সমাবেশও করেছে।
কিন্তু রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের প্রক্রিয়া কী, সংবিধানে বা কী আছে? এ নিয়ে সর্বত্র আলোচনা সমালোচনার দেখা দিয়েছে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। কিন্তু এখন স্পিকার নেই। আবার রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে হলে সংসদের দুই তৃতীয়াংশের সই ও ভোট লাগবে। কিন্তু এখন সংসদও নেই।
এছাড়া রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকারের দায়িত্ব পালনের কথা আছে। কিন্তু এখন স্পিকারও নেই।
এ অবস্থায় কেউ কেউ বলছেন, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাইতে পারে। যেমনটি হয়েছিল অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
সংবিধানের ৪৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
(৪) কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি-(ক) পঁয়ত্রিশ বৎসরের কম বয়স্ক হন; অথবা (খ) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য না হন; অথবা (গ) কখনও এই সংবিধানের অধীন অভিশংসন দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদ হইতে অপসারিত হইয়া থাকেন।
রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ
রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ নিয়ে সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসরের মেয়াদে তাহার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন: তবে শর্ত থাকে যে, রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তাহার উত্তরাধিকারী-কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। (২) একাদিক্রমে হউক বা না হউক-দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতির পদে কোনো ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। (৩) স্পিকারের উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারবেন। (৪) রাষ্ট্রপতি তাহার কার্যভারকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না এবং কোনো সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইলে রাষ্ট্রপতিরূপে তাহার কার্যভার গ্রহণের দিনে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
রাষ্ট্রপতির অভিশংসন
অভিসংশন নিয়ে সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
(১) এই সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাইতে পারবে; এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অনুরূপ অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে; স্পিকারের কাছে নোটিশ দেওয়ার দিন হতে ১৪ দিনের পূর্বে বা ৩০ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হইতে পারবে না; এবং সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করবেন।
(২) এই অনুচ্ছেদের অধীন কোনো অভিযোগ তদন্তের জন্য সংসদ কর্তৃক নিযুক্ত বা আখ্যায়িত কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের কাছে সংসদ রাষ্ট্রপতির আচরণ গোচর করিতে পারবেন।
(৩) অভিযোগ-বিবেচনাকালে রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকবার এবং প্রতিনিধি-প্রেরণের অধিকার থাকবে।
(৪) অভিযোগ-বিবেচনার পর মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিযোগ যথার্থ বলিয়া ঘোষণা করিয়া সংসদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করিলে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে।
(৫) এই সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ-অনুযায়ী স্পিকার কর্তৃক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব-পালনকালে এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলি এই পরিবর্তন-সাপেক্ষে প্রযোজ্য হইবে যে, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় স্পিকারের উল্লেখ ডেপুটি স্পিকারের উল্লেখ বলিয়া গণ্য হইবে এবং (৪) দফায় রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবার উল্লেখ স্পিকারের পদ শূন্য হওয়ার উল্লেখ বলিয়া গণ্য হবে; এবং (৪) দফায় বর্ণিত কোনো প্রস্তাব গৃহীত হইলে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে বিরত হবেন।
অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির অপসারণ
৫৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাহার পদ হতে অপসারিত করা যাইতে পারবে; ইহার জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে।
(২) সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে নোটিশ প্রাপ্তিমাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করবেন এবং একটি চিকিৎসা-পর্ষদ (অতঃপর এই অনুচ্ছেদে ‘পর্ষদ’ বলিয়া অভিহিত) গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করবেন এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তাব উত্থাপিত ও গৃহীত হবার পর স্পিকার তৎক্ষণাৎ উক্ত নোটিশের একটি প্রতিলিপি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন এবং তাহার সহিত এই মর্মে স্বাক্ষরযুক্ত অনুরোধ জ্ঞাপন করিবেন যে, অনুরূপ অনুরোধ জ্ঞাপনের তারিখ হতে ১০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি যেন পর্ষদের নিকট পরীক্ষিত হবার জন্য উপস্থিত হন।
(৩) অপসারণের জন্য প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের নিকট প্রদানের পর হইতে ১৪ দিনের পূর্বে বা ৩০ দিনের পর প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাইবে না, এবং অনুরূপ মেয়াদের মধ্যে প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্য পুনরায় সংসদ আহ্বানের প্রয়োজন হইলে স্পিকার সংসদ আহ্বান করবেন।
(৪) প্রস্তাবটি বিবেচিত হবার কালে রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকবার এবং প্রতিনিধি-প্রেরণের অধিকার থাকবে।
(৫) প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপনের পূর্বে রাষ্ট্রপতি পর্ষদের দ্বারা পরীক্ষিত হবার জন্য উপস্থিত না হইয়া থাকিলে প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাইতে পারিবে এবং সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তাহা গৃহীত হলে প্রস্তাবটি গৃহীত হবার তারিখে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।
(৬) অপসারণের জন্য প্রস্তাবটি সংসদে উপস্থাপিত হবার পূর্বে রাষ্ট্রপতি পর্ষদের নিকট পরীক্ষিত হবার জন্য উপস্থিত হয়ে থাকলে সংসদের নিকট পর্ষদের মতামত পেশ করবার সুযোগ না দেওয়া পর্যন্ত প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাবে না।
(৭) সংসদ কর্তৃক প্রস্তাবটি ও পর্ষদের রিপোর্ট (যাহা এই অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে পরীক্ষার সাত দিনের মধ্যে দাখিল করা হইবে এবং অনুরূপভাবে দাখিল না করা হইলে তাহা বিবেচনার প্রয়োজন হবে না) বিবেচিত হবার পর সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হলে তাহা গৃহীত হবার তারিখে রাষ্ট্রপতি পদশূন্য হবে।
অনুপস্থিতি প্রভৃতির-কালে রাষ্ট্রপতি-পদে স্পিকার ৫৪। রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদে স্পিকার
৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, রাষ্ট্রপতি গোপনীয়তার শপথ রক্ষা করতে পারেননি। পরে বঙ্গভবন থেকে বলা হয়েছে মীমাংসিত বিষয়। তার মানে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তারপর অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আইন দিয়ে সব সময় সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায় না। হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদের পতনের পর ৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। কিন্তু তখন সংবিধানে সেটা ছিল না। তখন রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে এটি হয়েছিল। আর ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট একটি উপদেশমূলক পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই পরামর্শের পর অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করে পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন। সেটা বড় কথা না। কথা হচ্ছে তিনি যদি পদত্যাগ করেন। তিনি নিজ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। এ মুহূর্তে কাউকে অ্যড্রেস করে পদত্যাগ করার বিষয় নেই এই রকম অস্বাভাবিক অবস্থায়। কেউ নেই এটা কোনো কথা না। কেউ ছিল না, কিন্তু সেই সময় অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছে। তখন প্রধানমন্ত্রী নেই, সংসদ নেই তখন এই সরকার গঠিত হয়েছে। ডকট্রিন অব নেসেসিটি, অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজন সেটা পূরণ করে দিবে। এখন সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে উপদেশমূলক পরামর্শ চাইতে পারে বলে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এখন আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখন সংসদ নেই। তবে যে কোনো সময় রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে পারেন। পদত্যাগে কোনো বাধা নেই। এখানে স্পিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু স্পিকার অনুপস্থিত। স্পিকার চলে গেলেও সংবিধান অনুযায়ী আরেকজন এই পদে না আসা পর্যন্ত তিনি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করবেন। যদিও সে অনুপস্থিত। রাষ্ট্রপতি চাইলে এখন ওনার পদত্যাগপত্র বঙ্গভবনে রেখে চলে যেতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্ব সম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারবেন।
Discussion about this post