ক্রমেই দখল ও দূষণ বেড়ে চলেছে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। নদীর দুই পাড়ে নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। যার মধ্যে আছে শিল্প-কারখানা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া প্রতিদিনই নদীতে পড়ছে টনে টনে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। যা নদী ভরাটের পাশাপাশি দূষিত করে তুলছে। এই নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত।
জানা গেছে, ভারতের মিজোরামে উৎপত্তি হওয়া এই নদী বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা হয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। পরিবেশবাদী সংগঠন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন ২০২২ সালে কর্ণফুলী নদীর গভীরতা ও দখল জরিপ করে। এরমধ্যে চাকতাই খালের মোহনার উত্তর পাশে নদীতে গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ১৩ ফুট। দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা পাওয়া যায় ৪৮ ফুট। রাজাখালী খালের মোহনায় গভীরতা পাওয়া যায় ৪ ফুট। ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় নদীর গভীরতা পাওয়া যায় সাড়ে সাত ফুট।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৯ সালের মে মাসে কর্ণফুলীর তীরের দুই হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে হাইকোর্ট চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করেন। অথচ জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ এই রায় বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে। হালদা মোহনা থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এলাকায় তিন হাজারের বেশি অবৈধ দখলদার নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছে। এসব স্থাপনা প্রতিনিয়ত নদীকে দূষিত করে তুলছে। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বারবার তাগাদা দিলেও আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থা।’
চলতি বছর প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে পরিবেশ দূষণ ও বিরূপ প্রভাব নিয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) করা এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত এতে নেতৃত্ব দেন। তাকে সহযোগিতা করেন পুরাকৌশল বিভাগের দুই শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া ও আল আমিন। গত ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা দলের সদস্য পিয়াল বড়ুয়া বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৪৯ টন হচ্ছে প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় বর্জ্য, যা কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। নদীতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নদীর তলদেশে কিংবা অন্যান্য স্তরে ভাসতে থাকা এসব প্লাস্টিক বর্জ্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এসব মাছ খাদ্য হিসেবে মানুষ গ্রহণ করায় মানবদেহে মিশে যাচ্ছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।’
অপরদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২১ সালের বর্জ্য বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরের বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন অন্তত ৭৮৫ টন বর্জ্য যাচ্ছে কর্ণফুলীতে। এরমধ্যে বেশি থাকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিক ও পলিথিন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইকো’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে কর্ণফুলী নদীর দূষণ নিয়ে এক গবেষণা চালানো হয়। ওই গবেষণা টিমের প্রধান ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৯টি উৎস এবং ৩০ কারণে কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য দায়ী। এরমধ্যে শিল্পকারখানা ৫৩টি, নৌযান মেরামতের জায়গাসহ ১৪টি, পাশাপাশি বাজার, নালা, খামার, শুঁটকি পল্লি অন্তর্ভুক্ত। এসব স্থাপনা কর্ণফুলী নদীর পানি, বায়ু, মাটি দূষণ করে চলেছে।
ওই গবেষণায় বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে ৫২৮ ধরনের উদ্ভিদ শনাক্ত হয়। এরমধ্যে ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে, ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দূষণ ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আরও ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে যাবে।
এতে আরও বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর দূষণ বন্ধ না হলে ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্ত হবে। নদীতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণের ফলে দৈনন্দিন কাজে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, যা থেকে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ ক্যানসার হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য বেশ কিছু কারণ আমরা শনাক্ত করেছি। এরমধ্যে রয়েছে নগরীর বর্জ্য বিভিন্ন নালা অথবা ড্রেন দিয়ে সরাসরি নদীর পানিতে মিশে যাওয়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বর্জ্য, নদীর শিকলবাহা এলাকায় পোড়া তেলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নদীর দুই পাশে প্রায় ৫০ হাজার খোলা শৌচাগার, নদীর পাশে থাকা বাসাবাড়ির সব বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ, শুঁটকি তৈরির কারখানা থেকে থেকে সৃষ্ট বর্জ্য, বাঁধ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, কৃষি জমি থেকে সার ও কীটনাশক নদীর পানিতে মিশে যাওয়া, অপচনশীল ভাসমান প্লাস্টিক ইত্যাদি দূষণের জন্য দায়ী।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবসৃষ্ট নানা কারণেই কর্ণফুলী দূষণ হচ্ছে।’ এর থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্টদের সচেতনতার প্রতি জোর দেন তিনি।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের উপদেষ্টা বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ভূমি দস্যুদের দখলের কবলে পড়ে কর্ণফুলী নদী পঙ্গু হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭০ লাখ মানুষের বর্জ্য ও পলিথিনের দূষণে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কর্ণফুলীর। যে কারণে দেশের অন্যতম খরস্রোতা এই নদী এখন মাছ ও জলজ প্রাণীশূন্য হয়ে পড়েছে। দূষণে ৭০ প্রজাতির মাছ এই নদী থেকে হারিয়ে গেছে। দেশের ৯২ শতাংশ অর্থনীতি সচল রাখা নদীর এই অবস্থা জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না।’
এদিকে, গত ৮ নভেম্বর কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ মাছ বাজার ও বরফ কল পরিদর্শন করেন জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, ‘আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এটা কর্ণফুলী নদী। কিন্তু এখানে এখন মাছ বাজার এবং হাজারও অবৈধ স্থাপনা।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্য নদীর সঙ্গে কর্ণফুলীর তুলনা হবে না। অন্য নদী আর কর্ণফুলী এক নয়। কর্ণফুলী দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই নদী দখল হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। কর্ণফুলী হচ্ছে ইউনিক (স্বকীয়) নদী। যেটি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীর বায়োডাইভারসিটি (জীববৈচিত্র্য) যেকোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে।’
Discussion about this post