ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ গত রাত ৯টার দিকে আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের উপকূলে। ভোলার পাশ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করে মাঝারি মাত্রার এ ঘূর্ণিঝড়। এ সময় প্রবল ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়। উপকূলীয় কিছু জেলায় ৯ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। গত রাত ১ টায় এ রিপোর্ট লেখার সময়ে আবহাওয়া অফিস জানায়, সিত্রাং পুরো অতিক্রম করতে আরো ঘন্টা দুয়েক লাগতে পারে। এর আগে রাত ৯টায় জানানো হয়েছিল উপকূল অতিক্রম করতে তিন-চার ঘন্টা সময় লাগতে পারে। উপকূল অতিক্রমের পর এটি ভোলা, নোয়াখালী, কুমিল্লা হয়ে ভোরের দিকে সিলেটে প্রবেশ করবে। সেখানে যেতে যেতে ঝড়টা শক্তি হারিয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে এবং এর পরে ভারতের মেঘালয়ে প্রবেশ করবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নগরের পতেঙ্গা, বাঁশখালীর খানখানাবাদ, কাহারঘোনা, ছনুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়। জোয়ারের পানি ওঠে নগরের হালিশহর, আগ্রাবাদ, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ নিচু এলাকায়। কঙবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় লোকালয়ে পানি ঢুকে যায়। ডুবে যায় নগরের এয়ারর্পোট সংলগ্ন নেভাল সড়ক। বিমানবন্দর সড়ক ও ইপিজেড রোডে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এবং ফৌজদারহাট জেলেপাড়া দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের আকমল আলী রোড সংলগ্ন জেলেপাড়ায় পানি ওঠে। সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার জেলে পরিবারের সদস্য বাস করে। রাত বাড়ার সাথে সাথে পানির উচ্চতা বাড়ছিল সেখানে। রাত পৌনে একটার দিকে তারা নিজেদের সহায় সম্বল নিয়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঢাকা, ভোলা, নড়াইল ও কুমিল্লায় গাছ পড়ে ও দেয়াল ধসে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে চার বছরের শিশুসহ এক দম্পতি প্রাণ হারিয়েছে। রাত ১১টার দিকে উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়নের হেসাখাল পশ্চিম পাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে বৈরী আবহাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সন্দ্বীপ। বন্ধ হয়ে যায় বিমান চলাচল। শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে গতকাল বিকেল ৩টা থেকে বিমানবন্দরে উড্ডয়ন এবং অবতরণ কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আজ বেলা ১২টা পর্যন্ত তা বন্ধ থাকবে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গাছ ভেঙে পড়লে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করার সময় জোয়ার ছিল। ছিল অমাবস্যা তিথি। সে সাথে বাতাসের গতি বেশি থাকায় চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ে। গত সাড়ে ১২ টার দিকে ভাটা শুরু হয়।
এদিকে উপকূল স্পর্শ করার সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা র্স্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ঘূর্ণঝড়ের প্রভাবে গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় আহাওয়া অফিস চট্টগ্রাম, মাংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। কঙবাজারে ছিল ৬ নম্বর বিপদ সংকেত। চট্টগ্রাম ও কঙবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৮ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়।
প্রসঙ্গত, আন্দামান সাগর ও দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি লঘুচাপ আকারে সৃষ্টি হয়েছিল ২০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টায়। সেটি ধীরে ধীরে ২১ অক্টোবর দুপুর ১২টায় সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। ২২ অক্টোবর নিম্নচাপ এবং ২৩ অক্টোবর গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এ পরিণত হয়। এ ঝড়ের ব্যাস ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূল অতিক্রম করার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিডিনিউজ জানায়, কোথাও কাথাও কোথাও সকাল থেকেই বিদ্যুৎ চলে যায়। আগের দিন রাতেও আগাম সতর্কতা হিসেবে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন সেসব এলাকার বাসিন্দা ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। এ কারণে সেসব এলাকায় দিনভরই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দেয়। সন্ধ্যার পর অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক আর কাজ করছিল না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার সন্ধ্যায় উপকূল অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত উপকূলীয় ১৫ জেলায় দুই লাখ ১৯ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্ধলক্ষাধিক গবাদি পশুকেও নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৭ হাজার ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ২৫ লাখ মানুষ ঠাঁই নিতে পারবে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে খোলা হয়েছে ৫১১ টি আশ্রয়কেন্দ্র।
সূত্র : আজাদী
Discussion about this post