রাজনীতিতে আমার নিজস্ব কোনও সিদ্ধান্ত নেই। আমি সবসময় নেত্রীর নির্দেশেই চলি। নিজের আগ্রহ না থাকলেও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা যদি চট্টগ্রামের মেয়র পদে মনোনয়ন দেন তাহলে ‘না’ করার সুযোগ নেই— জানালেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এমপি। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে আমার নিজস্ব কোনও সিদ্ধান্ত নেই। আমি সবসময় নেত্রীর নির্দেশেই চলি। নেত্রী যখন যেটা যেভাবে যে জায়গায় কাজ করতে বলেন তা আমি করতে বাধ্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি মেয়র পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী নই। আমি বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্বে আছি, যদি এরপরও তিনি আমাকে মেয়র পদে নির্বাচন করতে বলেন আমি নেত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবো না।’
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম-৯ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এসব কথা বলেন। নির্বাচনে নিজের প্রার্থী হওয়া, বর্তমান মেয়রের কর্মকাণ্ড নিয়েও কথা বলেছেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান মহিবুল হাসান নওফেল।
চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে জোর গুঞ্জন রয়েছে, দলের হাই কমান্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে নওফেলকে বাদ দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নওফেলকে মনোনয়ন দিতেই। বিশেষ করে এই ধারণার পালে হাওয়া লেগেছে সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাঈদ খোকনকে বাদ দিয়ে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে নুর তাপসের মেয়র পদে মনোনয়ন ও জয় লাভের ঘটনায়। তবে যাকে নিয়ে এতো গুঞ্জন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল— এটা কি গুঞ্জন নাকি সত্যি?
জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, ‘অনেকে আমার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। আমি আবার বলছি, সত্যি বলতে ব্যক্তিগতভাবে আমি মেয়র পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী নই। তবে গত কাউন্সিলের পর পার্টির সেক্রেটারি আমাকে মেয়র পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। তখন আমি উনাকে কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় থাকার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলাম। এরপরও আমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা নয়। আমার রাজনীতি নেত্রীর সিদ্ধান্তে পরিচালিত। নেত্রী যখন যেটা যেভাবে যে জায়গায় কাজ করতে বলেন তা আমি করতে বাধ্য।’
অনেকের ধারণা, বর্তমান মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরই মেয়র পদে দ্বিতীয়বারের মতো মনোনয়ন পাবেন। আবার অনেকে চমকের কথাও বলছেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে (ঢাকা বিভাগ) গত তিন বছর দায়িত্ব সামলে আসা মহিবুল হাসান নওফেলের কাছে এই ‘চমক’ নিয়ে ব্যাখ্যা কী?
চমকের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘দেখুন মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাওয়াটাই একটি চমক। ঢাকায় যেমন আওয়ামী লীগের পদে না থেকেও আতিক সাহেব এসেছেন, আবার এমপি পদ থেকে তাপস ভাই এসেছেন। তেমনি চট্টগ্রামেও সেই রকম চমক অপেক্ষা করছে। চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী মেয়র পদে লড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আবার আমাদের দলেরও বেশ কয়েকজন যোগ্য প্রার্থী আছে যারা এই পদের জন্য খুবই আগ্রহী। আবার অনেকে আমার কথাও বলছেন। এছাড়া বর্তমান মেয়রও কিন্তু স্ট্রং ক্যান্ডিডেট। যদি উনি আবার নমিনেশন পান সেটাও কম চমক নয়। সব মিলিয়ে বলতে পারেন এবারের মেয়র পদে আওয়ামী লীগ অবশ্যই চমক দেবে।’
বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের দাবি, গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকার ‘উন্নয়ন’ হয়েছে তার মেয়াদেই। এছাড়া দ্বিধাবিভক্ত নগর আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে তিনিই ‘ঐক্যবদ্ধ’ করেছেন। সেই হিসেবে মনোনয়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তার পাল্লাটাই ভারী। যদি দল থেকে নাছিরকেই মনোনয়ন দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো কত সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন— সেই প্রশ্নও ছিল সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনপুত্র নওফেলের কাছে।
প্রতি উত্তরে সরাসরি কোনও জবাব দেননি কোতোয়ালী-চকবাজারের সাংসদ মহিবুল হাসান নওফেল। তবে তিনি বলেছেন, ‘দেখুন আমরা এমন একজনকে মেয়র হিসেবে চাই। যিনি তার দায়িত্বটাই যথাযথভাবে যথাসময়ে পালন করতে পারেন। এখন আপনি মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে যদি নানা সংগঠন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সময় দেন তাহলে তো নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না। একজন মেয়রের কাজ শুধু নালা-নর্দমা পরিস্কার করা কিংবা লাইট জ্বালানো নয়। অনেক সময় বিরোধী পক্ষ থেকে এসব নিয়েও কথা শুনি। থাক আমি বর্তমান মেয়র নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’
নিজের প্রয়াত পিতা চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত ও টানা প্রায় ১৭ বছরের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সিটি করপোরেশন পরিচালনার উদাহরণ টেনে নওফেল বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে নিজে নিজে সব কিছু করা সম্ভব না। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের মতো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান চালানো তো মোটেই সম্ভব না। আমার বাবা যখন মেয়র ছিলেন তার একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল। আবু ইউসুফ আলম, পুলিন দে, অনুপম সেন, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী উনাদের মতো গুণিজনরাই আমার বাবাকে পরামর্শ দিতেন, উপদেশ দিতেন। বর্তমান মেয়রকে এই ধরনের উপদেশ দেওয়ার মতো কি কেউ আছেন বা তিনি কি রেখেছেন?’
আবার বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতার কথাও বলেছেন চট্টগ্রাম ৯ আসনের সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, ‘দেখুন আমরা নগরের এমপি। আমাদেরও নগরবাসীর কাছে জবাবদিহি করতে হয়। অনেক কাজ সিটি করপোরেশনের হলেও আমাদের কাছেও মানুষ আসে। কিন্তু মেয়র সাহেব নিজে নিজে সব কাজই করতে চান। কারও সঙ্গে সমন্বয় করতে চান না বলে তাও সম্ভব হয় না। শুধু আমি না, নগরীর উন্নয়নে নগরীর আরও যারা এমপি আছেন তাদেরকে মেয়র সাহেব ডেকেছেন কিনা আমার জানা নেই। চট্টগ্রামের মুরুব্বি মোশাররফ হোসেন আংকেল আছেন, ভূমিমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী উনাদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে নগরীর সমস্যা উন্নয়ন নিয়ে উনি কখনও কি বসেছেন? একসাথে বসলে পরামর্শ নিলে, অনেক কিছুই সহজে সমাধান সম্ভব হয়। সমন্বয় করে কাজ করলে সবার সহযোগিতা নিয়ে কাজ করলে সেখানে ছোট হওয়ার কিছুই নেই। চট্টগ্রামে যতোগুলো সরকারি স্কুলভবন হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলোই সিটি কর্পোরেশনের। সেক্ষেত্রে আমি কোনো কার্পণ্য করিনি। আপনি নিজেকে এতো বড় ভাবলে তো আর হবে না।’
নওফেলের এরকম প্রতিক্রিয়ার পর জানতে চাওয়া হয় তাহলে কেমন মেয়র চান আপনারা— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা একজন পারফেক্ট মেয়রই চাই। যিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটা যথাযতভাবে পালন করবেন। নিজের দায়িত্বকেই বেশি মূল্যায়ন করেন। সিটি করপোরেশনে সময় দেবেন।’
সবশেষে আবার জানতে চাওয়া হয়েছিল— বর্তমান মেয়রের যদি নানা সমস্যা থাকে, তাহলে যোগ্য প্রার্থী কি আপনি না অন্য কাউকে আপনি চান? এর উত্তরে নওফেল বলেন, ‘দেখুন আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি, মেয়র কে হবেন সেটি নেত্রীই সিদ্ধান্ত দেবেন। আমাকে প্রার্থী করলেও তো নির্বাচন করতেই হবে। সেটা আমি নিজে থেকে না চাইলেও নির্বাচন না করার উপায় নেই। কেননা গত সংসদ নির্বাচনেও আমি নিজ থেকে প্রার্থী হইনি। মেয়রের বিষয়েও আমার সিদ্ধান্ত সেই রকম। তবে সবকিছু মিলিয়ে বলতে পারি এবারের মেয়র নমিনেশনে চমক থাকবে। সেই চমক পর্যন্তই অপেক্ষা করুন।’
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমকে হারিয়ে নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছিল। ভোটগ্রহণের পর মে মাসেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা দায়িত্ব নেন। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও ৪১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সভা করেছেন ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনে বলা আছে, নির্বাচিত পরিষদের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সভার পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণের দিন থেকে ১৮০ দিন আগে পর্যন্ত যে কোনও দিন নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হতে হবে ২০২০ সালের ৫ আগস্টের মধ্যে।
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচন ভবনে কমিশনের বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর সাংবাদিকদের জানান আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের তফসিল। এই নির্বাচনটি হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে)।
Discussion about this post