যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিলনমেলা নামে খ্যাত ঐতিহ্যবাহী ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকার (ফোবানা)’র ৩৫তম সম্মেলন সফলে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে আমেরিকান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটি (এবিএফএস)। মেট্রো ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার দুই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বনাশ হয়েছে ৩৫তম ফোবানা সম্মেলন। এর ফলে ৩৪ বছরের ঐতিহ্য হারালো ফোবানা সম্মেলন।
গত ২৬ নভেম্বর শুক্রবার শুরু হওয়া ফোবানা সম্মেলনে চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, শিল্পী-কলাকূশলী আর পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি চরম অবহেলার মধ্য দিয়ে রবিবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। শতশত দর্শকশ্রোতার অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন বাজে ফোবানা এর আগে কেউ দেখেনি।
ম্যারিল্যান্ডের গেলর্ড ন্যাশনাল রিসোর্ট অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার ম্যারিয়ট হোটেলের ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৯ স্কোয়ার ফুটের মিলনায়তনে আসন সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) শুরু হওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আয়োজক ও ফোবানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া বহিরাগত দর্শক উপস্থিত হয়েছিল মাত্র ২ শতাধিক। পরদিন শনিবার (২৭ নভেম্বর) দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনের সময় দর্শক উপস্থিত হয়েছিল প্রায় ৮ শতাধিক এবং রবিবার (২৮ নভেম্বর) রাত পৌনে ১১ টায় ঢাকার জনপ্রিয় শিল্পীদের গানের সময় দর্শকশ্রোতার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩ শতাধিক। গত ৩৪ বছরের ইতিহাসে এত কম সংখ্যক দর্শক এর আগে কোন ফোবানা সম্মেলনে দেখা যায়নি। অথচ গত দুই বছর ধরে আমেরিকান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটি (এবিএফএস)-এর পক্ষে ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাপক প্রচারনা চালান সম্মেলনের আহবায়ক জি আই রাসেল ও সদস্য সচিব শিব্বির আহমেদ নামের মেট্রো ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার দুই প্রতারক। ৩৫তম ফোবানা সম্মেলনের নাম করে গত ২ বছর ধরে তারা দেশ ও বিদেশে পৃষ্টপোষকতার নামে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুষ্ঠানের প্রথম থেকেই জি আই রাসেল ও শিব্বির আহমেদ শিল্পীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, চুক্তি মোতাবেক তাদের সঠিক অর্থ প্রদান না করা, হোটেলে থাকের ব্যবস্থা ও পুরুস্কার প্রদানের নামে পৃষ্ঠপোষকদের সাথে নানা ধরণের প্রতারণা করে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুক্র ও শনিবার এ ধরনের আচরণের ফলে রবিবারের অনুষ্ঠানে উপভোগ না করেই হোটেলে ছেড়ে অধিকাংশ অতিথি বাড়িতে ফিরে যান। ফলে রবিবার সীমিত সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতে দেখা গেছে।
আদায়কৃত অর্থের বেশির ভাগই তারা দু’জনের পকেটস্থ করেছেন বলে স্নগশ্লিষ্টরা অনেকেই ধারনা করছেন। শুধু তাই নয় এবারের ৩৫তম ফোবানা সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আদম আমদানির জন্য লবিং করতে বেশ কয়েকদফা বাংলাদেশ পাড়ি জমান আহবায়ক জি আই রাসেল, সদস্য সচিব শিব্বির আহমেদ ও ফোবানা সম্মেলনের চেয়ারম্যান জাকারিয়া চৌধুরী। মোটা অংকের বিনিময়ে এবারে ৩৫তম ফোবানায় প্রায় ৬/৭ জন আদম নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন বলে বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে। এদের মধ্যে ২ জন ব্যাংক কর্মচারি রয়েছেন। এছাড়া আরও ৪/৫ জনকে সহযোগি শিল্পী হিসেবে নিয়ে আসেন বলে জানা গেছে।
করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কের নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কেলের আয়োজনে ৩৩তম ফোবানা সম্মেলন সফলে যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিল তার চেয়েও নিম্নমানের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো এবারের ৩৫তম ফোবানা। ২০১৯ সালে ৩৩তম ফোবানার আয়োজক ছিল নিউ ইয়র্কের নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কল। সবার সেরা হতে সংগঠনটি ভেন্যু হিসাবে বেঁছে নিয়েছিল লং আইল্যান্ডের নাসাউ কলিসিয়ামের মিলনায়তন। দু’দিন অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের ভাড়া বাবদ আয়োজকদের গুনতে হয়েছে ৩ লাখ ডলার বা বাংলাদেশি অর্থে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কলের অনভিজ্ঞতা এবং দুর্বল প্রচারের কারণে প্রায় ১৭ হাজার আসন ক্ষমতার মিলনায়তনে দ্বিতীয় দিনে ৮’শ থেকে ১ হাজার দর্শকে উপস্থিতি দেখা গেছে।
২০১৯ সালে যখন সবাই মূলত ৩৩তম ফোবানা সম্মেলনের সফল ও প্রবাসী বাংলাদেশী সংগঠনগুলোকে একতাবদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঠিক সেই সময়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের হাতে পরবর্তী ৩৫তম ফোবানা সম্মেলন তুলে দিতে ব্যস্ত ছিলেন। ওয়াশিংটন ডিসির এই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রকে যার কেন্দ্র রয়েছে ‘আমেরিকান বাংলাদেশ বিসনেস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি বাণিজ্যিক সংগঠন। যার নতুন নাম হয়েছে বাংলাদেশ আমেরিকান ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটি। এই সংগঠনটি পূর্বেও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের সহযোগিতায় ২০০৯ ও ২০১১ সালে দুইবার ফোবানা সম্মেলন আয়োজন করে যা ভুয়া ফোবানা সম্মেলন হিসাবে বহুল পরিচিত রয়েছে।
ফোবানা সম্মেলন এর মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন এ স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি ও প্রতারকচক্র সক্রিয় থাকবে এটাই স্বাভাবিক, তবে সম্মেলনটিই যখন কুক্ষিগত হয় তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশ আমেরিকান ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটি নামক সংগঠনটির পরিচালক অথবা মূলব্যক্তি স্টল বরাদ্দ, বিজ্ঞাপনের অঙ্গীকার, ব্যাবসায়িক অঙ্গীকার, ভুয়া কাগজে আদম আমদানি এমন কোন কর্মকান্ড নেই যা ২০০৯ ও ২০১১ সালের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জি আই রাসেল করেননি।
শুধুমাত্র সম্মেলনের নামে এবং বিভিন্ন অজুহাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকে এই প্রতারকচক্রটি বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে প্রবাসী রেজাউল করিমে কাছ থেকে ১০ হাজার, গোলাম ফরিদ আক্তারের কাছ থেকে ১২ হাজার, রফিকুল ইসলামে কাছ থেকে ৭ হাজার, জাকির হোসেন কাছ থেকে ১৫ হাজার, ব্যবসা লাইসেন্স করার নাম করে রাশেদুজ্জামান (রোমান)এর কাছ থেকে ২৩ হাজার, শামীম আলীর কাছ থেকে ৩৯ হাজার ও মাইনুল ইসলাম তাপসের কাছ থেকে ৭ হাজার মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।
এমনকি ফোবানা সম্মেলন শেষ করে ভেনু ভাড়া না দিয়ে শুধুমাত্র ফোবানা সম্মেলন নয় বরং পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির মুখে চুনকালি লেপ্টে দিয়েছেন এই প্রতারকরা। পরবর্তীতে ফেডারেল কোর্টে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে পিটিশন দাখিল করেছেন। আলেক্সান্দ্রিয়া ফেডারেল কোর্ট তাকে এবং তার স্ত্রীকে দেউলিয়া হিসাবে রায় দেন।
জি আই রাসেলের প্রতারণা শুধু ফোবানা সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতারণাই তার পেশা। কখনো সে ব্যবসার কথা বলে প্রতারণা করেন, কখনও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে কখনওবা সমাজ সেবা বা ধর্মের নামে প্রতারণা করেন বলে ভুক্তভোগীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন।
এ প্রতারক্রটি উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যবসার কথা বলে ও ব্যবসায় অংশীদারিত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে তার ফাঁদে ফেলেছেন। যার মধ্যে নাইমা রহমান কাছ থেকে ২৬ হাজার, পিপলস এন্ড টেক এর আবু হানিপের কাছ থেকে ১৮ হাজার, মেজর আলমের কাছ থেকে ২০ হাজার, ড. রাজ্জাকে কাছ থেকে ৮০ হাজার মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তার প্রতারনার তালিকায় আছে নাম না জানা আরো অসংখ্য বাংলাদেশি। রাজনৈতিক প্রভাবের ভয়ে চুপ থাকলেও পরবর্তীতে অনেকেই তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের ও প্রতারণার বর্ণনা দিয়েছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো ড. রাজ্জাক এর ঘটনা। তার স্ত্রী ড. নাজমা জাহানের কাছ থেকে জানা যায়, ড. রাজ্জাক এই প্রতারককে কয়েক দফায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দিয়েছিল ব্যবসায়িক কারণে। পরবর্তীতে যখন তিনি বুঝতে পারেন তিনি এক সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তখন তার আর করার কিছু ছিল না। ড. রাজ্জাক মানসিক ভাবে প্রচন্ডভাবে ভেঙে পড়েন এবং এই মানসিক যন্ত্রনায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এই প্রতারচক্রটি এতটাই চতুর যে তার খপ্পরে যে পড়ে সর্বশান্ত না হওয়া পর্যন্ত তার জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না অনেকেই। তিনি মসজিদ উন্নয়ন তহবিল এ অনুদান এর কথা বলে আলেক্সান্দ্রিয়া বাংলাদেশি কমিউনিটির এর মসজিদ উন্নয়ন তহবিল থেকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়াও বাংলাদেশে অনেক দরিদ্র পরিবারকে উত্তর আমেরিকায় এনে কাজ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবারগুলোকে সর্বশান্ত করছেন। যারা ফোবানার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদের সকলেই কমবেশি জানেন এ প্রতারকের কূ-কীর্তির কথা। কিন্তু এতকিছু জেনেও ফোবানার অভ্যান্তরিণ একটি স্বার্থান্বেষী মহল শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য ফোবানা সম্মেলনকে আবার এই প্রতারকের হাতে তুলে দিয়েছেন।
এই প্রতারক তার কূ-কীর্তি আড়াল করতে তার মতো আরো কয়েকটি পকেট সংগঠনকে নিয়ে একটি আয়োজক গোষ্ঠি তৈরি করেছেন। আর শিকড়বিহীন ব্যাঙের ছাতার মত এ সংগঠনগুলো কখনও সামাজিক আন্দোলন ও সমাজমুলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল না।
Discussion about this post